Wednesday, 28 May 2014

ফটোগ্রাফি আসলে কি? চলুন জেনে আসি

ফেসবুকে হাজার হাজার ফটোগ্রাফি দেখা যায়। কোনো কোনো ফটো দেখে চোখ মাথায় উঠে যায়। কিভাবে তুললো ছবিটা! এরকম পরিবেশ/ সিচুইয়েশন পায় কোথায়? কিছু ফটো দেখে তাজ্জব বনে যাওয়ার পর জিজ্ঞাসা করলে অনেকে বলে বসে এটাও ফটোগ্রাফি কিন্তু ছবির এই অংশ আর্টিফিশিয়াল বা এই ছবি মেনুপুলেশন, কমপজিশন করা। আর তখনই আমরা কনফিউশনে পরি তাহলে এগুলাও কি ফটোগ্রাফি না অন্য কিছু?
এবার google মামার সাহায্য নিয়ে কিছু তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করিঃ
প্রথমেই " Pure photography " বা " straight photography" কি ?
এইটা বোঝার জন্য Wiki থেকে পাওয়া এই দুইটা লাইনই যথেষ্ট - 
" Pure photography or straight photography refers to photography that attempts to depict a scene as realistically and objectively as permitted by the medium, renouncing the use of manipulation. Pure photography is defined as possessing no qualities of technique, composition or idea, derivative of any other art form."
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। পিওর ফটোগ্রাফি হলো আপনি একটা দৃশ্যকে ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবেন যেখানে ছবির কোয়ালিটি উন্নতি করার জন্য মেনুপুলেশন বা কমপজিশন তো দূরের কথা কোনো প্রকার টেকনিক/সফটওয়্যার ব্যাবহার করতে পারবেন না। যদি করেন তাহলে সেটা পিওর ফটোগ্রাফি না।

* তাহলে কোনো এডিটই করা যাবেনা ? কালার/কনট্রাস্ট/লাইট অ্যাডজাস্ট ও করা যাবে না? 
- না যদি আপনি পিওর ফটোগ্রাফি করতে চান তাহলে এগুলো আপনি পারবেন না। ক্যামেরা দিয়ে যা পাবেন ঐ টাই আপনাকে শেয়ার করতে হবে।
* আপনি বলতে পারেন কালার/কনট্রাস্ট/লাইট অ্যাডজাস্ট/ইফেক্ট সবাই দেয়! 
হ্যাঁ সবাই দেয় (আমি নিজেও করি এগুলো) কিন্তু আপনি/আমরা এগুলো করে পিওর ফটোগ্রাফিকে দূষিত ছাড়া কিছুই করছি না।
কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ বড় বড় ফটোগ্রাফাররা এই কাজটা করে বলে (কালার/কনট্রাস্ট/লাইট অ্যাডজাস্ট) সর্বজন স্বীকৃতি হিসেবেই ধরা হয়।
কিন্তু আপনি ফটো মেনুপুলেশন বা কমপজিশনকে এতো সহজে ফটোগ্রাফি বলতে পারবেন না।
যদি বলেন তাহলে বলবো Wiki তে গিয়ে ফটো মেনুপুলেশন বা কমপজিশন এর ব্যাপারে একটু পড়ালেখা করুন।
** ফটো কমপজিশনঃ
ফটো কমপজিশনের ক্ষেত্রে আপনি বলতে পারবেন এটা আপনার ফটোগ্রাফি কিন্তু আপনাকে কিছু নিয়ম মানতে হবে। এই ক্ষেত্রে আপনাকে আপনার তোলা একটা ফটো এর উপর কমপজিশন করতে হবে। কোনো জায়গা থেকে একাধিক ফটো কপি করে কমপজিশন করে নিজের ফটোগ্রাফি বলতে পারবেন না। 
(একটু নেট ঘাঁটলেই জানতে পারবেন)
আপনি গুগল থেকে একটা ছবি নিলেন, তারপর আরেকটা ছবি নিলেন, এক জায়গার ফুল আরেক জায়গার পাখি নিয়ে ফটোশপে জোড়া দিলেন, অভারলেপ করলেন, কম্পজিসন করলেন সেটাকে আপনি কোনোভাবেই নিজের ফটোগ্রাফি বলতে পারবেন না। আপনি ছবির মাঝে নিজের নামে "অমুক ফটোগ্রাফি" বসাতে পারবেন না। আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে এটা কম্পজিসন করা ফটো । আর যদি বসান তাহলে সব বড় বড় ফটোগ্রাফাররা গাধা ছাড়া কিছুই না 
কারণ ও উদাহরণ বলি, আপনি ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে কিছু ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝতে পারবেন, একটা ছবি তোলার জন্য একজন ফটোগ্রাফার কতো কষ্ট করে। একজন ফটোগ্রাফার দুটি পাখির মিলন এর ছবি তোলার জন্য গাছের উপর কয়েক সপ্তাহ বসে থাকে, মাছরাঙ্গার ছবি তোলার জন্য পানির ভিতর বস্তা পড়ে বসে থাকে । 
ফটোগ্রাফি যদি জোড়া তালি দেওয়া ছবিই হতো তাহলে তারা গাছের উপর ও উঠত না, বা গাধার মত পানিতে ও বসে থাকতো না, CS5 ডাউনলোড করে জোড়া তালি দেয়া শুরু করতো। অতএব কমপজিশন করলে বলতে হবে এটা কমপজিশন করা ফটো ।
** এবার আসি মেনুপুলেশন (manipulation) এর কথায় -
Wiki থেকে -
"Photo manipulation (also called photoshopping or—before the rise of Photoshop software—airbrushing) is the application of image editing techniques to photographs in order to create an illusion or deception (in contrast to mere enhancement or correction) after the original photographing took place."
এই ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই illusion বা একটা অবস্থানে আনতে হবে (Manipulation লিখে সার্চ দিন ক্লিয়ার হবেন)।
আপনি কখনই এটাকেও এতো সহজে ফটোগ্রাফির কাতারে ফালাতে পারবেন না ।
এক ধরনের মেনুপুলেশন করা হয় যেইটা বিভিন্ন জায়গার ছবি নিয়ে ফটোশপে একাধিক লেয়ার ইউস করে, বিভিন্ন কাজ করার পর একটি ভিন্নধর্মী Illusion তৈরি করা হয়। এটা ফটোগ্রাফি রিলেটেড কিছু না।
আরেকটি হলো কোনো তোলা ছবির উপর মেনুপুলেশন। এক্ষেত্রে আপনি মেনুপুলেশন করলে আপনাকে অবশ্যই আপনার তোলা একটা ফটো এর উপর কাজ (manipulate) করতে হবে এবং আপনাকে বলতে হবে Manipulation Photography শুধু ফটোগ্রাফি বলাটা অসম্ভব।
গ্লামার ফটোগ্রাফিতে মেনুপুলেশন করা হয় সেটাও কোন ছবি তোলার পর করা হয়। 
আর Manupulate করা ফটো দেখলেই বুঝতে পারা যায় ফটোগ্রাফি আর মেনুপুলেশন এর পার্থক্যটা কোথায়।
অনেক আর্ট ওয়েবসাইটে Photo manipulation Photography আলাদা ক্যাটাগরি রয়েছে। এর মানে অনেক স্পেশালিষ্ট এই দুটোকে পুরো আলাদাই বিবেচনা করেন।
* আরেকটা উদাহরণ বলি কেন এতো সহজে মেনুপুলেশন করা ফটোকে Photography বলতে পারবেন না,
কারণ আপনি কোনো Manipulation করা ওয়েবসাইটে কোথাও লেখা পাবেন না বা বলা নাই Manipulation >> "" Photography "" . 
এমনকি আপনি কোন বড় ফটোগ্রাফার এর ফ্লিকারস আইডিতে কোথাও Manupulate করা ছবির মধ্যে লেখা পাবেন না " অমক Photography " 
অতএব আপনাকে অবশ্যই ক্লিয়ার করে দিতে হবে আপনি আসলে কি করেছেন।
** পরিশেষে কিছু কথা বলি,
বর্তমানে ইচ্ছা করলেই মানুষ google থেকে ছবি নিয়ে একটু এডিট করে কিছু অংশ সরিয়ে কিছু অংশ জোড়া দিয়ে নিজের ফটোগ্রাফি নামে চালিয়ে দিতে পারে । এগুলা সফটওয়্যার এর অপব্যাবহার ছাড়া আর কিছু নয়।
নেট ঘাঁটলে লেখা পাবেন কোন ছবির উপর মেনুপুলেশন, কমপজিশন পিওর ফটোগ্রাফিকে শুধু দূষিতই করছে। কালো মডেলকে ফর্সা বানানো হচ্ছে, চিকনকে মোটা বানাচ্ছে সফটওয়্যার দিয়ে। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন ছবি নিয়ে মেনুপুলেশন বা কমপজিশন করা কোনো কাজের কাতারেই পড়ে না ফটোগ্রাফি তো দূরের কথা। 
নিশ্চয়ই মেসির সাথে দেখা করে তার সাথে ছবি তোলা আর ফটোশপ দিয়ে মেসির পাশে নিজেকে জোড়া দেওয়া এক না 
ফটো এডিট করে কালার/কনট্রাস্ট/লাইট/ফোকাস অ্যাডজাস্ট করা একটা কমন জিনিস হলেও একজন ভালো ফটোগ্রাফার হতে হলে ক্যামেরার ব্যাবহার শিখতে হবে । ক্যামেরার মাদ্ধমেই কালার/লাইট/ফোকাস অ্যাডজাস্ট করে একটা ভালো ছবি তোলা একজন ভালো ফটোগ্রাফার এর বহিঃপ্রকাশ।

//লেখাঃ মাসুদ রানা এবং রাউফুল আলম মজুমদার//

Wednesday, 21 May 2014

কিছু স্মৃতি

দেবাশীস চৌধুরী দেবঃ
যায়গাটা আমাদের মত ছন্নছাড়াদের জন্য বিশেষ আকর্ষণের। পিছনের কারণও প্রচুর। 
আমাদের কতশত ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে গেছে যায়গাটা। প্রেম নিবেদন, ফাটা প্রেম জোড়া লাগানো, প্রেমের সমাপ্তি, ডেটিং (মাইনষের), ডিটিং দেখা (মূলত জ্বালানো), ঝগড়া, জন্মদিনের পার্টি, কি করি নাই এই যায়গাটায় বসে!! যখনই ফাঁকা সময় পেয়েছি প্রকৃতি (!!!) আমাদের টেনে নিয়ে গেছে। 
সেদিনও বসলাম দলবল নিয়ে। একখান (আসলে অনেকগুলা, সবাই ভিন্ন ভিন্ন পোস নিয়া) ফটুও খিঁচা হল। আর ক্যামেরা লম্বুর ( Anik) গলায় ছিল।

Tuesday, 13 May 2014

গ্রামে এলো বাঘ


দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নতুন কোন ঘটনা নয়। ২০০৭ সনের সিডর’র ভয়াবহ স্মৃতি ও ক্ষয়ক্ষতির রেশ তখনো কাটেনি। বছর না ঘুরতেই এক রাতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে উপকুলের অনেক জেলা আবারও লন্ডভন্ড । মানুষ পশু সবার জীবনই ঝড়ে বৃষ্টিতে বিপন্ন। অনেক কাঁচা ঘরবাড়ীর ক্ষতি হয়েছে। এই ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে সুন্দরবনের বন্য পশু পাখিও রেহায় পায়নি।
সকাল হতেই দেখা গেল, চারদিকে মানুষের দুঃখ কষ্টের নানা চিত্র। সজিব দেখতে পেল, বাড়িরপাশের গাছ গাছালির ঝোঁপে হলুদ ডোরাকাটা এক লেজ । একটু কাছে গিয়ে ভাল করে দেখে তো সে অবাক. ’এ যে রয়েল বেংগল টাইগার’। দৌড়ে এক চিৎকার দিয়ে সজিব তার বাবা কে গিয়ে খবরটা দিল। দেখা গেল সত্যিই ঝোপের মাঝে ক্লান্ত বিষন্ন এক রয়েল বেংগল টাইগার শুয়ে আছ্ েসজিবের বাড়ি বাগের হাট জেলার সরণখোলা উপজেলায়। তাই বলে সে বাঘকে কোন সময় এমন করে লোকালয়ে চলে আসতে আর দেখেনি।
এতোক্ষণে আশে পাশে জানাজানি হতে বাকি নেই। লোকজনের ভীড় জমে গেল। সবার হাতেই দেশীয় অস্ত্র, লাঠি সোটা। যেন বাঘকে মারার জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ প্রস্তুতি। কেউ কেউ সবাইকে সর্তক করছে। কখন লাফ দিয়ে কার ঘাড়ে কামড় বসায় সে ব্যাপারেই সর্তকর্তা বেশী।
বাঘ যেন এতো লোকের সমাগম দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লো। ফ্যাল ফ্যাল করে নিচ দিকে তাকিয়ে আছে। আর মানুষের ভীড়ও বাড়ছে । কেউ কেউ বলছে‘ বিপদের মাঝে বিপদ’।
বাঘ শিকারী জুলফিকে খবর দেয়া হয়েছে। সবাই তার আসা পর্যšত সাবধানে অপেক্ষা করছে। কোথাও যেন পালাতে না পারে।
আশে পাশের অনেকেই ভয়ে ঘওে ঢুকে গেছে। ছোট বাচ্চাদেরও ঘরের ভিতর নিয়ে দরজা ব›ধ করে দেয়া হয়েছে। উদ্ধসুক জনতার ভীড় ক্রমেই বাড়তে থাকলো। গ্রামে খবর ছরীয়ে পড়লো‘ বাঘাডোবা গ্রামে সরকার বাড়িতে বাঘ একজন কে কামড়িয়েছে। বাঘ এখনো ধরা পড়ে নাই’। অনেকে বাঘের খবর শুনেই ভয়ে দৌঁড়াচেছ বাড়ির দিকে। যেন বাঘ তাকেই পেছনে ধাওয়া করছে। ছোট গ্রামটিতে হুলছু’ল পড়ে গেল। এরই মধ্যে খবর এলো বাঘের বাচ্চাও দেখা গেছে বাড়ির পেছনে জংগলের আরেক ঝোঁপে।
কেউ কেউ এবার সে দিকে ছুটলো। সত্যিই দেখা গেল ঝোঁপের নিচে ছোট এক বাঘের বাচ্চা শুয়ে আছে। কেউ একজন লাঠি দিয়ে আঘাত করতে গেল ।‘আগে এটাকে মারো’ বলে।
ভীড়ের মাঝে লাফ দিয়ে বাঘের বাচ্চার সামনে গিয়ে পড়লো সজিব’। ‘না আমি বাচ্চাটাকে মারতে দিবনা’। সবাই অবাক ।‘ সরে যা । তোকে কমড়াবে’ বলেও ভয় দেখালো কেউ কেউ । তবুও সজিব সরলো না। কাছে গিয়ে সে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। যেন বিড়াল ছানা । দশ বছরের সজিবের সাহস দেখে সবাইতো অবাক। সজিব বলে ‘আপনারা যান , আমি একে নিয়ে আসছি’। বাচ্চাটি সারারাত ঝড়, বৃষ্টিতে ভিজে আধামরা অবস্থা। নড়াচড়ার শক্তি নেই। শরীর ভেজা । আগে এর সেবা- শুষ্রুশা করা দরকার। সজিব এটাকে বাড়িতে লুকিয়ে নিয়ে গেল। বাঘে দেখে ফেললে বিপদ হবে তাই।
সজিব বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালো। আগুনের পাশে নিয়ে শরীর গরম করল। সজিব ভাবল ‘ হয়তো আরো বাচ্চা ছিল। সেগুলো জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। বাঘ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। সজিবের মনে উপকূলীয় মানুষের প্রাকৃতিক দুযোর্গের দঃখ, কষ্ট, স্বজন হারনোর কান্না ভেসে উঠল। বিপদে পড়েই বাঘ তার বাচ্চাসহ বাঁচার জন্যই গ্রামে চলে এসেছে। বিপদে সকল প্রাণিই এক। এটা মা বাঘ , নিশ্চয় তার সংগে আরো বাচ্চা ছিল। সেগুলো হযত মারা গেছে। মানুষ ঝোঁপঝাড়ে আরো খোঁজাখুঁজি করে আর কোন বাচ্চার সন্ধান পায়নি।
মা বাঘকে মেরে ফেললে বাচ্চাটার কী হবে ? তাছাড়া বাঘ মারাতো আইনত নিষেধ। সজিব স্কুলে তা শুনেছে। এসব কথা সজিবের মনে হতেই সে আর দেরী করলো না। দৌঁড়ে বাঘ যেখানে ,সেখানে চলে আসলো। সবাইকে বললো’বাঘকে মারা যাবে না’। শুনে সবাই হতভম্ব। বলে কী এই পিচ্চি ছেলে। সে বুঝিয়ে বললো বাচ্চাটার কথা , বিপদে আশ্রয়ের কথা, বাঘ মারা নিষেধ এসব বিষয়।
সজিবেরে বাবাও একমত হলো। সবাই সিদ্ধাšত নিল এক্ষুনি বন বিভাগে খবর দিবে। মা বাঘ ও বাচ্চাকে তাদের হাতে তুলে দিবে। কারণ শিশুরা যেমন মায়ের কোলে সুন্দর ও নিরাপদ, তেমনি বন্য প্রাণিরা বনেই সুন্দর, বনেই নিরাপদ।

ভূত ও শিয়ালের সংগে সজিবের মাছ ধরা


গতকাল রাতের, অবিরাম বর্ষনে চারদিক পানিতে থৈথৈ করছে। এসময়টাতে এরকম বৃষ্টি সচরাচর হয় না। ভাদ্র শেষ হয়ে আশ্বিনের সবে শুরু। ধানক্ষেত গুলো পানিতে ডুবো ডুবো। নিচু জমির ধানক্ষেত গুলো তলিয়ে গেছে। রাস্তা গুলো শুধু জেগে আছে। এরকম বৃষ্টির পর রাত থেকে সারা গ্রামে মাছ ধরার ধুম পড়ে গেছে। সকালে চারদিক পানি আর পানি এবং মানুষের মাছ ধরার ব্যাস্ততা দেখে সজিবের কাছে তা মাছ ধরার উৎসব মনে হল। ভোর থেকে গ্রামের সবাই মাছ ধরার নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে।
সজিবের বাবাও মাছ ধরার জন্য বাড়ি্র পাশেই খালে পানির প্রবাহ আটকিয়ে মাছ ধরতে বাঁশের তৈরী চালুন (ত্রিভুজাকৃতির মাছ ধরার যন্ত্র বিশেষ) পেতেছে। এটাতে পানির সাথে মাছ এসে পড়ছে। ছিদ্র থাকায় পানি পড়ে গেলেও মাছ থেকে যায় এই যন্ত্রে। পানির সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ এসে পড়ছে;মাঝে মাঝে কৈ, মাগুর শিং এসব মাছও পড়ছে দু-একটা। বেশির ভাগই ছোট মাছ পুটি, টেংরা, মলা এগুলো পাওয়া যাচ্ছে। থেমে থেমে মাছ পড়ছে। মাছ যন্ত্রে পড়েই কেমন লাফা লাফি করে, না দেখলে তা বোঝানো যাবেনা সজিব মনে মনে বলে। তার খুব ভালো লাগে মাছ ধরতে এবং মাছের এ দৃশ্য দেখতে। এভাবেই সারাদিন কেটে গেল সজিবের।
সাজিব সবার কাছে শুনেছে রাত না হওয়া পর্যন্ত ভালো মাছ (কৈ, শিং, মাগুর এ জাতীয়) মাছ পাওয়া যাবেনা। শিং ,মাগুর,কৈ, শৌল ও বড় মাছ রাতের বেলাই ধরা পড়ে। কিন্তু রাতে তো সজিবের পড়াশুনা আছে। তা ছাড়া রাতে বাবা তাকে তো যেতে দিবেনা মাছ ধরতে। রাতে পড়তে বসেও সজিবের পড়াশুনআয় মন নেই। কী ভাবে রাতে মাছ ধরতে যাবে তাই তার চিন্তার বিষয়। মার কাছে জানতে পারলো কাজের লোক রহিমকে নিয়ে সজিবের বাবা রাতে মাছ ধরতে গেছে। সে মাকে বললো" মা আমিও মাছ ধরতে যাবো'। মা বললো' তোর পড়াশুনা আছে রাতে মাছ ধরতে যাওয়া যাবেনা। তোর বাবা রাগ করবে'। আরো জানালো-তার বাবা রাত ৯ টা পর্যন্ত থেকেই চলে আসবে।
সজিবের মাথায় নতুন আইডিয়া চলে আসলো। সে চিন্তা করলো-তার বাবা মাছ ধরে চলে আসার পর যখন শুয়ে পড়বে, তখনই সে যাবে। ভালোই হলো।
সজিবের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরে ৬-৭ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। গ্রামের নাম বাঘাডোবা। গ্রামে দুটি বিল আছে। তাদের বাড়ির দক্ষিণে একটি,আর একটি পশ্চিমে। পশ্চিমের বিলের পাড়েই সজিবদেব বাড়ি। দেশি মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে হলেও তাদের গ্রামটি এখনো মাছের জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরা সাজিবের খুব ভালো লাগে । এটা তার সখ। এবার বর্ষা মৌসুম শেষে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে । বর্ষায় মাছ এক জায়গা হতে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। তবে শেষ বর্ষায় মাছ নাকি তার স্থায়ী আবাসস্থল বেছে নেয় । তাই মাছ আগে থেকেই বুঝতে পাড়ে শেষ বর্ষা বা শেষ ভারী বর্ষন কোনটি । এজন্যই মৌসুম শেষে ভারী বর্ষন হলে এক বিলের মাছ দল বেঁধে আরেক বিলে যাওয়ার জন্য জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
সজিবদের গ্রামে সবার বাড়িতে আজ মাছ আর মাছ । আত্বীয় স্বজনদের বাড়িতেও মাছ পাঠানো হয়েছে। অতিরিক্ত মাছ কেটে শুটকি দেওয়া হয়েছে । এ দৃশ্য আজ গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে।
রাত দশটার দিকে সজিব বুঝতে পারে তার বাবা শুয়ে পড়েছে । সে আস্তে আস্তে তার ঘর হতে বের হয়। তাদের কাজের লোক রহিমকে ডাকে উঠার জন্য। কিন্তু কোন সাড়া নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে। জোড়ে ডাকাও যাচ্ছে না। শেষে হারিকেন আর বাঁশের তৈরী মাছ রাখার পাত্র নিয়ে একাই রওনা দেয় সজিব। এসে দেখে অনেক মাছ পড়ে আছে, লাফা লাফি করছে তাদের মাছ ধরার যন্ত্রে। তাড়াতাড়ি এগুলো উঠিয়ে নিয়ে সজিব পাশে বসে পড়লো। একটু পর পর পানির সাথে মাছ এসে পড়ছে আর সজিব তা সাথে সাথেই ধরছে।মাছ ধরার আনন্দই আলাদা । তার কোন ভয়ও করছে না। মনে মনে বলে, কিসের ভয় আমি এখন ক্লাশ নাইনে পড়ি। আমি এখনো ছোট নাকি। চারদিকে অন্ধকার হলেও; আরো যারা মাছ ধরছে আশে পাশে তাদের বাতির অল্প অল্প আলো দেখা যাচ্ছে।
বেশিক্ষণ বিরতি দিয়ে মাছ এসে পড়লে তার কিছুটা ভয় ভয় লাগে। রাস্তার পাশেই মাছ ধরার ব্যবস্থা।কিন্তু লোকজনের চলাচল নেই। হঠাৎ রাস্তায় চোখ পড়তেই দেখে কিছু একটা যেন তার দিকে আসছে। সজিবের ভয় ভয় দৃষ্টি সে দিকে। অন্ধকার রাত তাই ভালো করে বুঝাও যাচ্ছে না।কাছা কাছি আসতেই দেখে শিয়াল। কিন্তু শিয়াল সোজ চলে না গিয়ে তার কাছা কাছি এসে দাঁড়ালো। এখন আবার তার ভয় করতে শুরু হলো। শিয়াল মানুষ দেখলে ভয়ে দৌঁড়ে পালায়।কিন্তু এতো দেখা যায় উল্টো। সজিব ভালো করে আবারও দেখলো। নিশ্চিত হলো এটা শিয়াল। সজিব ভাবলো শিয়াল তাকে একা পেয়ে হয়ত ভয় পাচ্ছে না। শিয়াল যদি তাকে এখন কামড়ে দেয়-সে কী করবে। এখন মাছ ধরার চেয়ে শিয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। কারণ অন্য দিকে তাকালেই যদি তার দিকে লাফ দিয়ে কামড়ে দেয়। এখন কীভাবে শিয়াল তাড়ানো যায় এটাই তার বড় চিন্তা । মাছ চালুনে পড়ে লাফিয়ে পানিতে পড়ছে,উজিয়ে চলে যাচ্ছে তবুও সজিবের সেদিকে খেয়াল নেই।
সজিব পানি ছিটিয়ে দিলো শিয়ালের দিকে কাজ-হলো না । এবার কাঁদা ছুঁড়ে-দিল। শিয়াল বিরক্ত হয়ে চলে গেল। সজিব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো । তাড়াতাড়ি জমে থাকা মাছ গুলো ধরে নিল।
সজিবের কেমন যেন ভয় ভয় লাগতে থাকে , শেয়াল চলে যাওয়ার পরও। একটু পর দেখে আবার সেই শেয়াল হাজির । এসে রাস্তায় তার কাছা কাছি দাঁড়িয়ে আছে । সজিব এবার নিশ্চিত হলো বেটা শিয়াল তাকে ভয় পচ্ছে না । সজিব বিড় বিড় করে বললো-ঃ আমাকে ছোট এবং একা পেয়েছো ? শিয়ালকে এজন্যই ধূর্ত প্রাণি বলা হয়-মনে মনে বললো সে। এবারও সজিব শিয়ালের দিকে পানি ছিটিয়ে দিল। নাহ্-কোন কাজ হলো না। আবার কাদা ছুঁড়ে দিল, তাতেও কাজ হলোনা। শিয়াল যাচ্ছে না ।
এখন সে ভয় পেতে শুরু করলো। সজিবের মনে হলো-তবে কী এটা কোন শিয়াল নয় ? শুনেছে ভূত নাকি বিড়াল,কুকুর,শিয়াল সেজেও রাতে চলা ফেরা করে। একথা মনে হতেই তার গায়ের লোম ভয়ে খাড়া হয়ে গেল। দো,দরুদ পড়তে থাকলো । বুকে ফু দিল দোআ পড়ে। হঠাৎ মনে পড়লো-ভূত তো আগুন দেখলে ভয় পায় । তাই পরীক্ষা করে দেখা যাক। সে ম্যাচের শলা দিয়ে আগুন ধরিয়ে সেদিকে ছুঁড়তে থাকলো । ফলাফল একই । শিয়াল যাচ্ছেনা । যাক তাহলে এটা নিশ্চিত এটা ভূত নয় শিয়াল । ভূত নয় বুঝতে পেরে সজিব যেন শিয়ালকে পেয়ে খুশি হল। কিন্ত শিয়াল এরকম করছে কেন ? যাচ্ছে না কেন ?হঠাৎ মনে হল মাছ দিয়ে দেখিতো কী করে । সজিব শিয়ালের দিকে মাছ ছুঁড়ে দিল। শেয়াল লাফ দিয়ে ধরে তা খেয়ে ফেললো । তার এবার আর বুঝতে বাকি রইল না শিয়াল মাছ কাঁকড়া এসব খাওয়ার জন্য এসেছে। সে শিয়ালকে আরো কয়েকটি মাছ দিল। শিয়াল মাছ পেয়ে তার আরো কাছা কাছি চলে আসলো। মনে হলো-সজিবের কাছে সে মাছ চায়। যেন সজিবের পোষা শিয়াল ! সজিবের বাবা রাতে মাছ ধরে চলে যাওয়ার পর ফাঁকা পেয়ে শিয়াল মনে হয় এখানে মাছ,কাঁকড়া এসব খেয়েছিল। এজন্য তার লোভ হয়ে গেছে।সজিব চলে আসায় শিয়ালের অসুবিধা হচ্ছিল। তাই শিয়াল ঘুরে ফিরে এখানে আসছে।
মাঝে মাঝে মাছের সাথে কাঁকড়া ধরা পরলে সজিব শিয়ালকে দিচ্ছে। এভাবেই চললো কিছুক্ষণ। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে এক কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ করতেই শিয়াল ভয়ে পালালো । শিয়ালকে কুকুর তাড়া করে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে হয়তঃ ।
চারদিকে নিস্তব্দতা নেমে এলো । পানির শু-শু-শু শব্দ ছাড়া আর কোন কিছু নেই। রাতও মনে হয় অনেক হয়েছে। আবার সজিবের মনে ভয় লাগা শুরু হলো। নিস্তব্দতায় হয়তঃ ভয় ভয় করছে। কিন্ত না এবার সত্যি তার মনে ভিন্ন ভয় পেয়ে বসলো।যেখানে বসে মাছ ধরছে তার উত্তর পাশের বাড়ির জংগলে হঠাৎ কিসের যেন আলো জ্বলছে আর নিভছে। এ আলো দেখে সজিবের মনে হলো-ভূতেরা রাতের বেলায় পোকা-মাকড় খাওয়ার জন্য নাকি আলো জ্বালিয়ে মুখ হাঁ করে বসে থাকে।পোকা-মাকড় গুলো ঢুকলে যখন মুখ বন্ধ করে তা খায়  তখন আলো দেখা যায় না। এসব কথা সে বহু শুনেছে। সজিব গ্রামের ছেলে হলেও তার বয়সে সে কোনদিন রাতে একা বের হয়নি। জীবনে প্রথম মাছ ধরার সখের নেশায় আজ সে ভয়ানক সব বিপদের মুখোমুখি। কী করবে এবার-ভেবে পায়না সজিব।ভয়ে শরীর ঘেমে যাচ্ছে। পানি পিপাসাও পেয়েছে খুব। সোজা মাছ রেখে বাড়িতে এক দৌঁড় দিবে-এখন সে অবস্থাও নেই। কারণ ভূত-তো মুহুর্তেই তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় চলে এসেছে। এখন তো সে আলো রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। সজিব ভেবে পাচ্ছে না কী করবে।ম্যাচের কাঠি দিয়ে আবারও আগুন ধরাতে লাগলো। রডের ( লোহার) একটি টুকরো ছিল লাঠি হিসেবে তা হাতে নিল। কারণ ভূত লোহা আর আগুন কারো সংগে থাকলে নাকি তার কাছে আসেনা ।
সজিব ভাবলো ভূতকেও না হয় শিয়ালের মতো মাছ খেতে দিবে। দেখা যাক পরে কী করে । ভয় পেলে সজিব গান গাওয়ার চেষ্টা করে ভয় কে তাড়াতো ।কিন্তু সে কথা মনে হলেও গলা থেকে গান বের হলো না।বরং ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। এখন তো ভূতের আলোও দেখা যাচ্ছে না। ভূত কোন পর্যন্ত এসেছে তা বুঝবারও উপায় নেই। এটা আরো বিপদজনক। যদি হঠাৎ পেছন দিক দিয়ে এসে ঘার মটকে দেয়।তা হলে? এসব প্রশ্ন ও জবাব নিজের মনে নিজেই দিয়ে যাচ্ছে-সজিব । এবার দেখা গেল ভূত মুখে আলো জ্বালিয়ে রাস্তা ধরেই আসছে। সজিবের সারা শরীর ভয়ে ঘেমে যেতে থাকলো। ধীরে ধীরে ভয়ে তার শরীর যেন অবস হয়ে আসছে। তবুও সজিব মনোবল শক্ত করে লোহার রড হাতে নিয়ে প্রস্তুত। আলোটা কাছা কাছি আসতেই সজিব যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ভয়ে অজ্ঞআন হওয়ার মতো ছিল তার অবস্থা। আর এখন দেখে এ যে জোনাকি পোকা । যাক এবার বড় বিপদ হতে রক্ষা পেলাম-বলে নিজের বুকে থু থু করলো সজিব।
'আর মাছ ধরতে হবে না। বেঁচে গেছি'। সত্যিই ভূত হলে আজ কী উপায় হত-সে ভেবে পাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ওঠে বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সজিব। হঠাৎ শব্দে কান খাড়া হয়ে গেল তার।ভয় পেয়ে তাকিয়ে দেখে পানি থেকে লাফ দিয়ে মাছ গিয়ে পড়েছে রাস্তায়।বড় কোন মাছ হবে। তাই হারিকেন রাস্তাঅয় রেখে মাছটাকে ধরতে গেল। কোথা থেকে সেই শিয়াল আবার তার সংগে মাছ ধরার জন্য যেন কাড়াকাড়ি শুরু করল। শৌল মাছ তাই লাফাচ্ছে। ধরা গেল না। আবার লাফ দিয়ে পানিতে গিয়ে পড়লো। শিয়ালের জন্য এত বড় শৌল মাছটা তার ধরা হলো না। তাই বলে এর জন্য কোন আফসোস নেই। তবে উভয়েই উভয়ের প্রতি যেন বিরক্ত হলো।
সজিব আর এক মূহুর্ত দেরী না করে সোজা বাড়ি চলে গেল।মাছগুলো বারান্দায় বড় পাতিলে পানি দিয়ে জিইয়ে রেখে ঘুমাতে গেল।সকালে মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো। সজিবের মা ভোরে ঘরের বারান্দায় এত মাছ দেখে অবাক।এত মাছ এলো কোথ্থেকে!সজিবের বাবাও অবাক হল। রহিমও জানে না। তাহলে এতো মাছ আসলো কোথ্থেকে! শুধু সজিব কে জিজ্ঞাসার বাকি। সজিবের মা নিজে নিজেই ভাবে সজিব তো আরো বলতে পারবে না
সজিব চোখ কচলে মাকে বললোঃ 'কী হয়েছে মা-এতো ডাকাডাকি করছো কেন? মা বললো-  দেখ কী ভূতুরে ঘটনা। কোথ্থেকে আমাদের বারান্দায় এতো মাছ.......! এটুকু বলে মা রহিমকে বললো-'এগুলো মাছ খাওয়া যাবেনা । তাড়াতাড়ি এগুলো পুকুরে ফেলে দিয়ে আয়'। সজিব সংগে সংগে বলে ওঠলো না-মা এগুলো ভূতুরে মাছ নয়। এগুলো আমি ধরেছি।
শুনে তার মা খুশী হবে না বকা দিবে বুঝে ওঠতে পারলোনা। বললো আর কোন দিন রাতে একা মাছ ধরতে যাবে না।রাতে বড় মানুষও একা মাছ ধরতে যায় না-এটুকু বলতেই সজিব মনে মনে মার কথার সাথে সুর মিলিয়ে ,বললো ঠিক বলেছ মা। আর সশব্দে শুধু বললো-সত্যি মা, 'আমি আর একা কোনদিন রাতে মাছ ধরতে যাবো না'

বীরশ্রেষ্ট মতিউর রহমানের শেষ চিঠি




প্রিয়তমা মিলি,
একটা চুম্বন তোমার পাওনা রয়ে গেলো। সকালে প্যারেডে যাবার আগে তোমাকে চুমু খেয়ে বের না হলে আমার দিন ভালো যায় না। আজ তোমাকে চুমু খাওয়া হয় নি। আজকের দিনটা কেমন যাবে জানি না। এই চিঠি যখন তুমি পড়ছোআমি তখন তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। ঠিক কতোটা দূরে আমি জানি না।
মিলি, তোমার কি আমাদের বাসর রাতের কথা মনে আছে? কিছুই বুঝে উঠার আগে বিয়েটা হয়ে গেলো। বাসর রাতে তুমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যখন কাঁদছিলে, আমি তখন তোমার হাতে একটা কাঠের বাক্স ধরিয়ে দিলাম। তুমি বাক্সটা খুললে, সাথে সাথে বাক্স থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকী বের হয়ে সারা ঘরময় ছড়িয়ে গেলো। মনে হচ্ছিলো আমাদের ঘরটা একটা আকাশ, আর জোনাকীরা তারার ফুল ফুটিয়েছে! কান্না থামিয়ে তুমি অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, ‘আপনি এতো পাগল কেনো?’ মিলি,আমি আসলেই পাগল, নইলে তোমাদের এভাবে রেখে যেতে পারতাম না।
মিলি, আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন প্রিয় কন্যা মাহিনের জন্মের দিনটা। তুমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলে। বাইয়ে আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি, আমি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কষ্টে পুড়ে যাচ্ছি। অনেকক্ষণ পরে প্রিয় কন্যার আরাধ্য কান্নার শব্দ, আমার হাতের মুঠোয় প্রিয় কন্যার হাত! এরপর আমাদের সংসারে এলো আরেকটি ছোট্ট পরী তুহিন। মিলি, তুমি কি জানো, আমি যখন আমার প্রিয় কলিজার টুকরো দুই কন্যাকে এক সাথে দোলনায় দোল খেতে দেখি, আমার সমস্ত কষ্ট, সমস্ত যন্ত্রণা উরে যায়। তুমি কি কখনো খেয়াল করেছো, আমার কন্যাদের শরীরে আমার শরীরের সূক্ষ একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়? মিলি, আমাকে ক্ষমা করে দিও।
আমার কন্যারা যদি কখনো জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা কেনো আমাদের ফেলে চলে গেছে?’ তুমি তাঁদের বলবে, ‘তোমাদের বাবা তোমাদের অন্য এক মা'র টানে চলে গেছে, যে মা'কে তোমরা কখনো দেখো নি। সে মা'র নাম 'বাংলাদেশ'। মিলি, আমি দেশের ডাককে উপেক্ষা করতে পারি নি। আমি দেশের জন্যে ছুটে না গেলে আমার মানব জন্মের নামে সত্যিই কলঙ্ক হবে। আমি তোমাদের যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি আমাকে জন্ম দেওয়া দেশটাকে। যে দেশের প্রতিটা ধূলোকণা আমার চেনা। আমি জানি, সে দেশের নদীর স্রোত কেমন, একটি পুটি মাছের হৃৎপিন্ড কতটা লাল, ধানক্ষেতে বাতাস কিভাবে দোল খেয়ে যায়....!
এই দেশটাকে হানাদারের গিলে খাবে, এটা আমি কি করে মেনে নিই? আমার মায়ের আচল শত্রুরা ছিড়ে নেবে, এটা আমি সহ্য করি কিভাবে মিলি? আমি আবার ফিরবো মিলি, আমাদের স্বাধীনদেশের পতাকা বুক পকেটে নিয়ে ফিরবো। আমি, তুমি, মাহিন ও তুহিন, বিজয়ের দিনে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াবো সবাই। তোমাদের ছেড়ে যেতে বুকের বামপাশে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। আমার মানিব্যাগে আমাদের পরিবারের ছবিটা উজ্জ্বল আছে, বেশি কষ্ট হলে খুলে দেখবো বারবার।
ভালো থেকো মিলি, ফের দেখা হবে। আমার দুই নয়ণের মণিকে অনেক অনেক আদর।
ইতি,
মতিউর।
২০ আগস্ট, রোজ শুক্রবার, ১৯৭১