ইউনিভার্সিটি অফ
এশিয়া প্যাসিফিক এর কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ৪র্থ
বর্ষের ৪০ জন শিক্ষার্থীদের নিয়ে হয়ে গেল ডিপার্টমেন্টের প্রথম ইন্ডাস্ট্রিয়াল
ট্যুর। উদ্দেশ্য- কক্সবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন
পরিদর্শন ও সেখানে সেমিনারে অংশগ্রহন। একই সাথে ৪ দিনের সফরে
কক্সবাজার-সেন্ট-মার্টিন-বান্দরবন ভ্রমন। ৩০তম ব্যাচের উদ্যোগ ও আয়োজনে গত কয়েক
সপ্তাহের দৌড়াদৌড়ির পর অবশেষে ট্যুরটা হতে চলেছে।
২৮শে ডিসেম্বর
রাত ৯টায় শীতের রাত উপেক্ষা করে ক্যাম্পাস থেকে বিআরটিসি এসি পরিবহনে করে আমরা
রওনা হলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। উৎসাহের আধিক্যে চৌদ্দগ্রামে মধ্যরাতের খাবারের
বিরতি পর্যন্ত সারা রাতই বাসে চলল গান-বাজনা। সকাল ৬:৩০ এ আমরা পৌছলাম কক্সবাজারে,
কলাতলীতে
হোটেল এরিয়ায়। শেষ রাতের কম্বল জড়ানো শীতের কাঁপন কেটে ভোরের মিষ্টি আলোয় ঘুম ভেঙ্গে
দেখলাম কক্সবাজারকে। হোটেলে উঠে বিশ্রাম নিয়ে নিচে নেমে সারলাম গরম গরম পরোটা,
ভাজি
আর ডিম দিয়ে সকালের নাস্তা। নাস্তা সেরেই আমরা গেলাম সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং
স্টেশন পরিদর্শনে।
ME-WE-4 কানেকশনের ১৬টি দেশের সাথে বাংলাদেশ
যেরূপে সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হলো তার সচিত্র বিশ্লেষণ, এর উদ্দেশ্য,
কার্যকারিতা
ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে আমরা অংশ নিলাম। হালকা নাস্তার
আতিথেয়তার পর আমাদেরকে ল্যান্ডিং স্টেশনের যন্ত্রাংশসমূহ ঘুরে ঘুরে দেখানো হলো।
এরপর আমরা ফিরে
আসলাম হোটেলে। দুপুরের খাবারের পর ৩টি জিপ গাড়ি (চান্দের গাড়ি) যোগে আমরা রওনা
হলাম ইনানী সমুদ্রসৈকতে যেখানে বিশাল সমুদ্র আর বেলাভূমির সৌন্দর্য মন মাতিয়ে
রাখে। জিপ গাড়িতে করে যাওয়ায় পথের যে সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ হয়েছে তা ভোলার নয়।
টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে এক পাশে উঁচু উঁচু পাহাড় আর
আরেক পাশে উত্তাল সমুদ্রের ঊর্মিমালা। যাওয়ার পথে একটি ঝরনাও দেখা যায়।
সৌন্দর্যের
মাদকতা আছে। অপরূপ ইনানী সৌকতে নামার পরই মহাকর্ষ-অভিকর্ষ ছেড়ে কোন এক অজানা
আকর্ষণে আমাকে মুহুর্তে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলল জলে। এরপর চেয়ে দেখি শুধু আমিই নই,
কেউই
বাদ যায়নি সে আকর্ষণে। এমনকি আসার পথে বিশাল দেহধারী বন্ধু অনিরুদ্ধ যে বারবার
বলছিল জলে নামবে না, সেও উপেক্ষা করতে পারেনি। উপরে উন্মুক্ত আকাশ, নিচে দিগন্ত
বিস্তৃত নীল জল- এ উদারতা, এ বিশালতা, এ মাদকতা কতদিন
পাইনি!!
আসিফ স্যার নেমে
পড়েছেন গভীর জলে, তার ডাকে আমরাও এগিয়ে গিয়ে একসাথে ঝাপাঝাপি শুরু করলাম। আমি
খুঁজছিলাম সাথে আসা সিনিয়র শিক্ষক গানের পাখি শায়লা ম্যামকে। ম্যামকে বলেছিলাম,
'ভয়
নেই, একবার
গিয়েই দেখুন। আপনার শরীর ও মন দুটোই বরং সুস্থ হয়ে উঠবে'। দেখি একটু দূরে ম্যামও সাগর জলে পা ভেজাতে নেমে পড়েছেন।
গুনগুন করে হয়ত গান গাচ্ছেন-
"আমি কখনো যাইনি
জলে, কখনো
ভাসিনি নীলে,
কখনো রাখিনি চোখ,
ডানা
মেলা গাংচিলে"।
ব্যতিক্রম শুধু
সাদাত স্যার। তিনি তার ট্রাইপড-ডিএসএলআর নিয়ে নেমে পড়েছেন ফটোগ্রাফিতে। ইনানী
সৌকতে সব ভুলে আমরা এতটা সময়ই পানিতে ছিলাম যে শেষে ফেরার পথে আর হিমছড়িতে যাওয়া
হয়নি। হোটেলে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ক্লান্ত ও মুগ্ধতার আবেশে ঘুমিয়ে পড়লাম
তাড়াতাড়ি। পরদিন ভরে উঠতে হবে, গন্তব্য সেন্ট-মার্টিন।
পাঠকদের বলে
রাখি, ইনানী
সৌকতে নামতে হলে অবশ্যই অতিরিক্ত শুকনো জামা-কাপড়, পলিথিন নিয়ে
যাবেন। ভেজা কাপড় পরেই ইনানী থেকে হোটেলে ফিরলে পথে রাতের সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাসে
নিঃসন্দেহে জ্বরে পড়বেন। ওখানে কাপড় পরিবর্তনের জায়গাও আছে। জনপ্রতি নেয় ২০টাকা।
আমার মত বহু মানুষকে দেখবেন সৌকতেই লুঙ্গি দিয়েই কাপড় পরিবর্তন করে ফেলছে।
পরদিন ভোরে আধো
ঘুম চোখে ডাক পড়লো, সেন্টমার্টিনের কথা মনে পরতেই সবার ঘুম পালিয়ে সতেজ! একটি ট্রাভেল
এজেন্সির প্যাকেজে ছিল আমাদের কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন-কক্সবাজার অংশের ভ্রমন।
বাসে করে গেলাম টেকনাফ। টেকনাফ জেটি থেকে উঠলাম এম.ভি.ফারহান জাহাজে (সত্যিকার
অর্থে- জাহাজ বললেও সেন্টমার্টিন রুটের সবগুলোই আসলে লঞ্চ)। জেটির খাল পেরিয়ে ৫
মিনিটের মধ্যেই নাফ নদীতে উঠে ডান চোখর পাহাড় রাশির কোল ঘেঁষে আমরা এগোতে লাগলাম।
একসময় আমরা পড়লাম সাগরে। সাগরে প্রবেশের সময় থেকে আমাদের সঙ্গী হলো ঝাঁকে ঝাঁকে
অসংখ্য গাংচিল। লঞ্চের সামনে এবং দু'পাশে শত খানেক গাংচিল আমাদেরকে যেন 'গার্ড অব অনার'
দিয়ে
নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় মধ্য রাস্তা পর্যন্ত তারা আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে গেলো, আবার মধ্য সাগর
পাড় হবার পরেই ওপাড়ের গাংচিলগুলো এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেলো গন্তব্যে।
সকাল ৯টায় জাহাজ ছেড়ে সকাল ১১টায় আমরা পৌছলাম স্বপ্নের সেন্টমার্টিনে। বাজি ধরে
বলতে পাড়ি সেন্টমার্টিনের উপকূলে পৌঁছতেই এর অপূর্ব সৌন্দর্যে আপনি প্রেমে পড়ে
যাবেন। সবুজাভ গাঢ় নীল স্বচ্ছ স্ফটিক জল ঢেউ খেলে আছড়ে পড়ছে প্রবাল সৌকতে।
জাহাজ থেকে নেমে
স্থানীয় ভ্যানগাড়িতে করে আমরা গেলাম হোটেল সী-প্রবাল এ। আমরা এখানেই থাকব দেড় দিন।
আয়োজক হয়েও স্বীকার করি এই হোটেলটির মান তেমন ভাল না। আমাদের যাত্রার দিন-তারিখ
পরিবর্তন হওয়ায় পূর্ব নির্ধারিত হোটেল শৈবাল এ শেষপর্যন্ত আমরা রুম পাইনি। হোটেল
শৈবাল বেশ ভাল। সেখানে সামনেই পশ্চিমপাড়ের প্রবাল বিছানো সৌকত। আমরা খাওয়া-দাওয়া
অবশ্য করেছি এ হোটেলের সামনের পশ্চিমপাড়ের বাজারে। আমাদের হোটেল থেকে পশ্চিমপাড়ের
এখানে হেঁটে আসতে সময় লাগে ১০ মিনিট। আমাদের হোটেলের একমাত্র সুবিধা ছিল- এই
হোটেলের সামনের সৌকতটাই শুধু প্রবাল ছাড়া, মেয়েদের জন্য
হাত-পা না কেটে পানিতে নামার সৌকত। ঠিক ডান পাশেই অবশ্য আবার প্রবালের শুরু।
যাই হোক-
বিশ্রাম নিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা নামলাম সৌকতে, ফ্রেন্ডলি ফুটবল
ম্যাচে। কেয়া গাছের ডালে পড়ে বল ফুটো হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বিপক্ষ দলের অধিনায়ক
জিসান ভাই এবং পরে আমার দলের অধিনায়ক হিসেবে আমার দেয়া গোলে খেলা ১-১ এ সমতায় ছিল।
খেলা শেষে সবাই মিলে ঝাপিয়ে পড়লাম সেন্টমার্টিনের নীল স্বচ্ছ উত্তাল তরঙ্গে। সকল
ভয়-ভীতি কাঁটিয়ে শায়লা ম্যামও এবার নেমে পড়লেন পানিতে। বন্ধু মেহেদী তো সাঁতরাতে
সাঁতরাতে পাড়ের দিকে রাখা ট্রলারে উঠে গেল।
উঠে গোসল সেরে
এবার বের হলাম প্রবালদ্বীপ দারুচিনিদ্বীপ পরিদর্শনে। অসংখ্য কেয়া গুল্ম, সবুজ বনানী আর নারিকেল
গাছ এই দ্বীপকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা, নাম দিয়েছে নারিকেল জিঞ্জিরা। হাঁটতে
হাঁটতে পশ্চিমপাড়ে পেয়ে গেলাম হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি 'সমুদ্র বিলাস'। হাঁটতে থাকলাম পাড় ঘেষে।
দিনের শেষ আলোতে যখন জোয়ারের শেষ ধাক্কায় বড় বড় ঢেউগুলো বিশাল গর্জন করে সাদা ফেনা
তুলে
আছড়ে পড়ছিল প্রবাল পাড়ে পিছনের কেয়াবনের গাঢ় অন্ধকার যেন নিয়ে যাচ্ছিল
স্বপ্নপূরী-পাতালপূরীর গল্পে। রাত বাড়াতে ফিরে এলাম। পাঠকদের জানিয়ে রাখি-
সেন্টমার্টিনে রাতে হাটাহাটি নিরাপদ নয়। প্রায়ই রোহিঙ্গা ও স্থানীয় ডাকাতদের হামলা
হয়। আর অবশ্যই সমুদ্রে গোসল বা খেতে যাওয়ার সময় দামী ক্যামেরা-মোবাইল সঙ্গে করে
নিয়ে যাবেন। হোটেলগুলোতে প্রায়ই দামী জিনিস চুরি হয়।
রাতে আমাদের
জন্য কোন ডিনার ছিল না। ছিল পরোটা আর সাথে আসিফ স্যারের নেতৃত্বে ফিশ ও চিকেন বারবিকিউ। ক্যাম্পফায়ার
জ্বলে উঠতেই আমরা একে একে জড়ো হলাম। চলল বারবিকিউ, খাওয়া-দাওয়া,
গান-বাজনা।
সেন্টমার্টিনের
অপার সৌন্দর্যের আরেক রূপ ধরা পড়লো রাতে। ১২টায় বের হয়ে দেখি নীল জলের আছড়ে পড়া
ঢেউয়ে সৌকত পাড় জ্বলছে। দিগন্ত জোড়া আকাশ আর বিপুল ফেনীল জলরাশির মধ্যে হাজার মাইল
দূরে এক মায়াদ্বীপে বাঁধ ভাঙ্গা চাঁদের আলোয় আমরা ক'জন নেমে গেলাম
পা ভেজাতে। চন্দ্রস্নান, সমুদ্রস্নান, সাগরের জলভরা
সঙ্গীত- প্রকৃতি সত্যিই অপার।
পরদিন ঘুম থেকে
উঠলাম অনেক বেলা করে। নাস্তা সেরেই জেটি থেকে জীবনে প্রথমবার স্পিডবোটযোগে রওনা
হলাম ছেড়াদ্বীপ। ১০ মিনিটের যাত্রায় যে এডভেঞ্চার ছিল তা ভোলার নয়। সেন্টমার্টিন
ঘুরতে এসে মাত্র ১ঘন্টা সময় বের করে ছেড়াদ্বীপ না ঘুরে ফিরে যাওয়া সত্যিই বোকামি।
ছেড়াদ্বীপের বৈশিষ্ট্য হলো প্রবাল দ্বীপ বলতে যা বোঝায় এ দ্বীপটা তাই-ই।
সেন্টমার্টিনে আপনি মাটি-বালু পাবেন। কিন্তু ছোট্ট ছেড়াদ্বীপের পুরোটাই পাথুরে,
প্রবালে
ভরা। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের ভূমিখন্ডে পা রেখে ফিরে আসলাম আধ ঘন্টা পরেই। বিকাল
৩টার ফিরতি জাহাজে আমরা ছেড়ে আসলাম স্বপ্নের সেন্টমার্টিনকে। রাত ১০টায় পৌছলাম
কক্সবাজার হোটেলে। রাতের খাবার সেরে বের হলাম ১০ মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বে লাবনী
সৌকতে। 'থার্টি ফার্স্ট নাইট' উদযাপনে দেশের সবচেয়ে বড় কনসার্টটি
হচ্ছে এখানে। একই বিচে ৩টি কনসার্ট। আইয়ূব বাচ্চু আর জেমস পাশাপাশি দুই স্টেজে।
দুই গুরুর পাগল করা সব গান আর রাত ১২টা ১ মিনিটে অসংখ্য আতশবাজির উৎসবে নতুন বছরের
উদযাপনটা সত্যিই অসাধারণ ছিল।
ক্লান্তদেহে
হোটেলে ফিরে দীর্ঘ ঘুম দিলাম মায়াদ্বীপ সেন্টমার্টিন এর স্বপ্ন দেখে। হরতালের
ঝামেলার কারণে ইতোমধ্যেই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বান্দরবন বাতিল হয়েছে।
পরদিন আমরা
কক্সবাজারেই বিশ্রাম নিলাম। দুপুরের খাবার পর নামলাম লাবনী সৌকতে। মুগ্ধ নয়নে
অবসন্ন দেহটিকে এলিয়ে দিলাম সাগরের নীল জলে। রাতের বাসেই ঢাকা ফিরবো। আবার কবে
আসবো জানিনা। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এই বন্ধু-পরিজনদের নিয়ে আর আসা হবে না।
শুধু থেকে যাবে স্মৃতি। যে স্মৃতি ভবিষ্যতে আমায় হাসাবে-কাঁদাবে আর মাঝরাতের
স্বপ্নে দেখা দিবে, নিয়ে যাবে চন্দ্রালোকিত দারুচিনিদ্বীপের নীল জলের অতল গভীরে, প্রবালের নিচেই
যেখানে শুরু স্বপ্নপূরীর।
No comments:
Post a Comment